শনিবার ১১ অক্টোবর ২০২৫ - ১৬:৫২
নারী ও পুরুষ মধ্যে এত পার্থক্য সত্ত্বেও কি তারা একসঙ্গে সুখী জীবন গড়তে পারে?

নারী ও পুরুষের স্বভাব ও ব্যক্তিত্বে পার্থক্য স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। তবে এসব পার্থক্য কোনোভাবেই জীবনের মূল্য কিংবা দাম্পত্য সফলতার মাপকাঠি নয়। বরং পারস্পরিক বোঝাপড়া, গ্রহণযোগ্যতা, এবং আত্মউন্নয়ন—এই তিন উপাদানই একটি সুস্থ ও আনন্দময় সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: পারিবারিক ও দাম্পত্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন রেজা ইউসুফজাদে এক আলোচনায় “বিবাহ, সন্তান প্রতিপালন ও আবেগীয় সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা” বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে বক্তব্য রাখেন।

আলোচনার প্রধান বিষয়সমূহ

১. পারস্পরিক পার্থক্য বোঝা ও তা পরিচালনার মাধ্যমে দাম্পত্যে সমন্বয় আনা

২. একগুঁয়ে সন্তানের আচরণ নিয়ন্ত্রণে বৈজ্ঞানিক ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি

৩. কর্মব্যস্ত জীবনে সঙ্গীর প্রতি মনোযোগ ও ভারসাম্য রক্ষা

৪. বহু বছরের বিবাহিত জীবনে হারানো ভালোবাসা ও উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে আনা।

৫. সামাজিক চাপের মুখে মানসিক দৃঢ়তা বজায় রাখা

৬. আত্মচেতনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্পর্কের স্থিতি ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষা

পার্থক্য মানেই দ্বন্দ্ব নয়

হুজ্জাতুল ইসলাম ইউসুফজাদে বলেন, নারী ও পুরুষের ভিন্নতা কোনো প্রতিযোগিতা নয়—বরং পরিপূরকতা। সাধারণত পুরুষ বিষয়গুলোকে সার্বিক বা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য দিয়ে দেখেন, আর নারীরা খুঁটিনাটি ও সূক্ষ্ম দিকগুলোতে মনোযোগী হন।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “খাবার টেবিলে পুরুষ সাধারণত খাওয়ার দিকেই মনোযোগ দেন, কিন্তু নারী খাবারের উপস্থাপনা ও পরিবেশের সৌন্দর্যের দিকেও নজর রাখেন। এই পার্থক্য যদি বোঝা না যায়, ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি থেকে অপ্রয়োজনীয় তর্ক সৃষ্টি হয়।”

তিনি যোগ করেন, “সামাজিক অনুষ্ঠানের পর নারীরা কথাবার্তা ও ঘটনার বিস্তারিত মনে রাখেন, আর পুরুষ কেবল মূল বিষয়টি মনে রাখে। যদি উভয় দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে কাজ করা যায়, সিদ্ধান্তগুলো হয় অধিকতর পরিপূর্ণ ও ফলপ্রসূ।”

তিনি বলেন, কুরআনের দৃষ্টিতেও নারী ও পুরুষের পার্থক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য সংঘাত নয়, বরং পরিপূর্ণতা অর্জন।

সন্তান প্রতিপালন: পরিবারের পরিবেশই প্রথম শিক্ষা
একজন অভিভাবক জানতে চান, “আমার সাত বছরের ছেলে খুব একগুঁয়ে। আদেশ মানে না, পুরস্কারেও সাড়া দেয় না।”

তিনি উত্তরে বলেন, “শিশুকে বোঝার আগে ঘরের পরিবেশ বোঝা জরুরি। যদি দাম্পত্য সম্পর্কে কলহ বা শীতলতা থাকে, তার প্রতিফলন সরাসরি সন্তানের আচরণে পড়ে।”

তিনি কুরআনের বাণী উদ্ধৃত করে বলেন, “সন্তান ন্যায়ের ও শান্তির ফুলের মতো। ফুল যেমন উর্বর মাটি, আলো ও পানির প্রয়োজন করে, তেমনি শিশুর বিকাশেও দরকার ভালোবাসা, স্বাধীনতা ও পারস্পরিক সম্মানের পরিবেশ।”

তার ভাষায়, “অভিভাবকত্ব মানে শিশুকে নিয়ন্ত্রণ করা নয়; বরং তার বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। ভালোবাসা হলো পানি, স্বাধীনতা হলো আলো, আর পিতা-মাতার সম্পর্ক হলো সেই মাটি যেখানে শিশুটি শিকড় গাঁথে।”

কর্মব্যস্ত স্বামীদের প্রতি বার্তা: ভালোবাসা শুধু দায়িত্ব নয়, মনোযোগও প্রয়োজন
একজন শ্রোতা অভিযোগ করেন—“আমি সারাদিন পরিশ্রম করি, ঘরে কিছুই কম রাখিনি, তবু স্ত্রী বলেন, আমি তার প্রতি মনোযোগ দিই না।”

জনাব ইউসুফজাদে বলেন, “এটি আজকের সময়ের একটি সাধারণ বাস্তবতা। অনেক পুরুষ মনে করেন তাদের দায়িত্বপালনই ভালোবাসার প্রকাশ। কিন্তু নারীরা ভালোবাসা অনুভব করেন মনোযোগ ও সান্নিধ্যের মাধ্যমে।”

তিনি বলেন, “স্ত্রীর অভিযোগ আসলে ভালোবাসার ভাষা—এটি আক্রমণ নয়, আকাঙ্ক্ষা।” তার মতে, “প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে অন্তত ১০–১৫ মিনিট ফোন বা টেলিভিশন ছাড়াই শুধু স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোই সবচেয়ে কার্যকর ভালোবাসার প্রকাশ।”
এই সামান্য সময়ের আন্তরিকতা, ঘরের আবহ ও সম্পর্ক—সবই বদলে দিতে পারে।

নিস্তেজ সম্পর্কেও ভালোবাসা ফিরতে পারে
দশ বছর বিবাহিত এক দম্পতি অভিযোগ করেন—“সবকিছু নিয়মমাফিক চলছে, কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা হারিয়ে গেছে।”

তিনি বলেন, “ভালোবাসা হারায়নি, শুধু প্রকাশের ধরন বদলে গেছে।” তার পরামর্শ, ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে তিনটি ধাপ অনুসরণ করুন:

▫️আবেগ প্রকাশে সাহসী হোন: প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ও সৌজন্য শব্দ ব্যবহার করুন।

▫️দৈনন্দিন ক্ষুদ্র যত্ন নিন: একসাথে সময় কাটান, ছোট উপহার বা প্রিয় খাবার দিন।

▫️ যৌথ স্মৃতি ও নতুন অভ্যাস তৈরি করুন: প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট সময় শুধু দুজনের জন্য রাখুন—হাঁটা, আড্ডা বা পুরনো ছবি দেখা।

তিনি বলেন, “এই ছোট ছোট পদক্ষেপই রুটিনমুখী জীবনকে আবার প্রাণবন্ত ও উষ্ণ করে তুলবে।”

অবিবাহিতদের জন্য পরামর্শ: পারিবারিক চাপ সামলান শান্তভাবে
৩২ বছর বয়সী এক কর্মজীবী নারী বলেন, “পরিবার, বিশেষ করে মা, বারবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন। এতে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।”

হুজ্জাতুল ইসলাম ইউসুফজাদে বলেন, “এ ধরনের চাপ সাধারণত ভালোবাসা ও দুশ্চিন্তা থেকে আসে, নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নয়।”

তিনি প্রস্তাব করেন ‘দ্বিমুখী কৌশল’:*
অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ: নিজের উদ্বেগের কারণ বিশ্লেষণ করুন ও মানসিক স্থিতি বজায় রাখুন।

বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ: ভদ্রভাবে সীমা নির্ধারণ করুন—যেমন বলুন, ‘আমি বিষয়টি ভাবছি, কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি।’

দূর আত্মীয় বা বন্ধুদের প্রশ্নে শান্তভাবে উত্তর দিন: “এটি ব্যক্তিগত বিষয়, এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।” ধৈর্যের সঙ্গে একই বার্তা পুনরাবৃত্তি করলে চাপ স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূল চাবিকাঠি: আত্মচেতনা ও অভিযোজন
তিনি আরও  বলেন, “নিজেকে জানা ছাড়া অন্যকে জানা যায় না।”
তবে ‘আমি যেমন আছি, তেমনই থাকব’—এই মনোভাব বিপজ্জনক, কারণ এটি শেখা ও বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়।

তার ভাষায়, “বিবাহ মানে একসাথে শেখা ও বেড়ে ওঠা। সম্পর্ক তখনই টিকে থাকে, যখন উভয়েই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকে।”

তিনি উপসংহারে বলেন, “যখন নারী ও পুরুষ নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝে পারস্পরিক সম্মান, সহমর্মিতা ও বিকাশের পথে হাঁটে—তখন বিবাহ কেবল একটি সামাজিক বন্ধন নয়, বরং ভালোবাসা ও মানবিকতার এক সুন্দর যাত্রায় পরিণত হয়।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha